সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
প্রিয় পাঠক, আসুন আপনাদেরকে মা ও মেয়ের একটা গল্প শোনাই। গল্পটা মা ও মেয়ের ঠিকই। একসঙ্গে গুরু শিষ্যেরও গল্প। মায়ের নাম মোমেনা চৌধুরী, দেশের একজন বিশিষ্ট অভিনেত্রী। টিভি, চলচ্চিত্র, মঞ্চ সবখানেই তার সরব উপস্থিতি। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা একক অভিনয়ের নাটক ‘লালজমিন’ তার অভিনীত এ সময়ের সর্বাধিক আলোচিত মঞ্চনাটক। মেয়ের নাম নভেরা রহমান। ডাক নাম অডিসি। শিশু বয়স থেকেই অভিনয়ের প্রতি তার ঝোঁক শুরু হয়। নভেরার মায়ের মন্তব্যÑ ও যখন আমার পেটে একটু একটু করে বড় হচ্ছে তখন আমি মঞ্চে অভিনয় করছি। তখন অনুভব করতাম নতুন একটা জীবন আসছে। ওর বয়স যখন ৪০ দিন মঞ্চের পাশে ট্রাংকের উপর শুইয়ে রেখে অভিনয় করেছি। ও যখন একটু একটু করে বড় হতে থাকল তখন দেখতাম অভিনয়ের প্রতি বিশেষ করে নাটক সম্পর্কিত বিষয়ের প্রতি তার ঝোঁক বাড়ছে। সম্প্রতি কানাডায় অভিনয় ও ডিরেকশনের ওপর ২ বছরের একটা কোর্স করে এসেছে। শূন্যন নামে একটি নাট্য সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। নাটক নিয়ে দেশেই কিছু একটা করতে চায়।
মা ও মেয়ে দুজনই এসেছিলেন আনন্দ আলোর অফিসে। দুজনের চেহারায় দারুণ মিল। বিশেষ করে চোখের মায়া দুজনেরই সমান। নভেরা শান্তশিষ্ট অনেক আধুনিক একটি মেয়ে। অভিনয়ের জগতে মা তার আইডল। কিন্তু সে নিজেকে নিজের মতো করে গড়ে তুলতে চায়। তার স্পষ্ট কথাÑ আমরা তরুণেরা রাজনীতির কোনো বিভাজন বুঝি না। দেশের জন্য, নিজেদের জন্য ভালো কিছু করতে চাই। সেজন্য কাজের পরিবেশ দরকার।
মাকে তো প্রায় সকলেই চিনেন। কাজেই মেয়ের কথা একটু বলি। একসময় নিজের দেশের কিছুই তেমন একটা ভালো লাগতো না অডিসির। একধরনের অস্থিরতা থেকেই কানাডায় পড়তে যায়। এর পরই বদলে যেতে থাকে মনমানসিকতা। দেশের প্রতি মায়া জন্মাতে থাকে। নভেরার ভাষ্য ‘ওরা কাজের প্রতি বেশ সিরিয়াস। অনেকে চাকরি করে। পাশাপাশি থিয়েটারে সময় দেয়। কলটাইম ১০টা মানে ৯টা ৫৯ মিনিট। কিন্তু মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ওরা বেশ বাণিজ্যিক। আড্ডা আলোচনায় কে কতটা বিয়ার খেয়েছে, কে কার সঙ্গে আজ ডেটিং করবে এসবই গুরুত্ব পায় বেশি। এসব কারণে কানাডায় বসে বসে দেশের কথা ভাবতাম। হোক দেশটা গরিব। কিন্তু মানুষগুলো মানবিক সম্পর্ককে খুব গুরুত্ব দেয়। খুব সহজে একজন অন্যজনের সাহায্যে এগিয়ে আসে। দেশের প্রতি মায়া জন্মেছে। এবার দেশেই কিছু করতে চাই।’
কানাডায় একটা থিয়েটার কোম্পানির সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছে নভেরা। এই থিয়েটার কোম্পানি মূলত পরিবেশ নিয়ে কাজ করে। আর তাই মাঝে মাঝে গভীর জঙ্গলে নাটক মঞ্চস্থ হতো। দর্শক শহর থেকে গাড়িতে করে জঙ্গলে এসে হাজির হন। তারপর দর্শকের সামনেই নাটক মঞ্চস্থ হতে থাকে। প্রায় চোখের পলকে অভিনেতা অভিনেত্রীরা তাদের অভিনয়ের জায়গা বদল করেন। তখন দর্শক হেঁটে গিয়ে আবার নতুন জায়গায় অভিনয় দেখার জন্য দাঁড়িয়ে যান। নভেরার মন্তব্য অভিনয়ের এই ধরনটা আমি বেশ উপভোগ করতাম। দর্শকের অনেকেই ভাবতো আমি বোধকরি ও দেশেরই লোক।
কানাডায় নাটকে অভিনয়, কস্টিউম ডিজাইন, লাইট প্রক্ষেপণ, মেকআপসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর পড়াশোনা করেছে নভেরা। দেশে ফিরে শূন্যন এর সঙ্গে জড়িত হয়েছে। ৭১ এর ১০টি চিঠি নিয়ে একটি নাটক করার পরিকল্পনা করছে নভেরা।
এবার মায়ের কথায় আসা যাক। মোমেনা চৌধুরী আরণ্যক নাট্যদলের সক্রিয় কর্মী। আরণ্যকের একাধিক মঞ্চনাটকের নির্ভরযোগ্য অভিনেত্রী তিনি। তবে শূন্যন প্রযোজিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একক মঞ্চনাটক ‘লালজমিন’-এ অভিনয় করে তিনি ব্যাপক আলোচিত হয়েছেন। ‘লালজমিন’-এ মোমেনা একজন কিশোরীর ভ‚মিকায় অভিনয় করেন। বয়স তার চৌদ্দ ছুঁই ছুঁই… দুচোখ জুড়ে মানিকবিলের আটক লাল পদ্মের জন্য প্রেম। কৈশোরেই শোনে বাবা-মায়ের মধ্য রাতের গুঞ্জন। শুধু দুটি শব্দ কিশোরীর মস্তকে আর মনে জেগে রয় ‘মুক্তি আর স্বাধীনতা’। ঐ বয়সে কিশোরী এক ছায়ার কাছ থেকে প্রেম পায়। বাবা যুদ্ধে চলে যায়। অগোচরে কিশোরী নানা কৌশলে যুদ্ধে যাবার আয়োজন করে। সশস্ত্র যুদ্ধ। বয়স তাকে অনুমোদন দেয় না। এবার কিশোরীর সেই ছায়া প্রেম সম্মুখে দাঁড়ায়। কিশোরী তার সেনাপতিকে চিনতে পারে। তারপর যুদ্ধযাত্রা…
মোমেনার ভাষায় মঞ্চে ‘লালজমিন’ শুরুর ইতিহাস অনেকটা এরকম “১৪ মার্চ লালজমিনের পাÐুলিপি পাঠ করেন নাট্যকার মান্নান হীরা। ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠি। ৩৭ পৃষ্ঠার একটা পাÐুলিপি। কি করে আমি ধারণ করবো। সাহস হারাই। কিন্তু সাহস যোগায় কন্যা নভেরা, সুদীপ চক্রবর্তী এবং মান্নান হীরা। মঞ্চে ৩০ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে মনে সাহস সঞ্চয় করে শুরু করি মহড়া। সংলাপ আত্মস্থ করি মেডিটেশনের মাধ্যমে। নির্দেশক অনেক কঠোরতার মাধ্যমে আমাকে তৈরি করতে থাকেন। কিশোরী দুরন্ত মোমেনার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাই চরিত্র নির্মাণে। প্রথম যেদিন পুরো নাটক মহড়া হয় সেদিনই আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই…।”
হ্যাঁ এই আত্মবিশ্বাসই মা ও মেয়ের চলার পথের শক্তি ও প্রেরণা। মা যেমন নাটক নিয়েই কাটালেন তার জীবনের প্রায় পুরো অংশ, মেয়েও তেমনি নাটকে সময় দিতে চান। তবে মায়ের চেয়ে মেয়েকে অনেক বাস্তববাদী মনে হলো। বোধকরি সেটা মায়ের জীবন দেখা শেখা। মা যে ভুলগুলো করেছেন মেয়ে সেই ভুলগুলো আর করতে চান না।
মা ও মেয়ে কার চোখে কেমন? প্রশ্ন ছুড়ে দিতেই প্রথমে মুখ খুললেন নভেরা। বললেন, মা আমার জীবনের আইডল। বাস্তববাদী একজন মহিলা। যা করেন মন দিয়ে করেন। তার মধ্যে শঠতা নাই। তার এই গুণটাই আমার বেশি পছন্দ। এবার মেয়ের দিকে তাকালেন মমতাময়ী মা। একটু যেন আবেগ আপ্লুত। আমার মেয়ে বলে বলছি না নভেরা খুব ল²ী মেয়ে। খুবই শান্ত কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে অনায়াসে। দেশের প্রতি তার অনেক মায়া। সেজন্য বিদেশে গিয়েও থাকতে পারেনি। দেশের টানে ফিরে এসেছে। ও ভালো অভিনয় করে। দক্ষ কস্টিউম ডিজাইনার। দিনে দিনে আমি ওর ফ্যান হয়ে যাচ্ছি।
এক সময় আড্ডা শেষ হয়। মা ও মেয়েকে মুখোমুখি দাঁড় করাই আমরা। সুন্দর একটা ছবি দেখতে পাই দুজনের। যে ছবিতে লুকিয়ে আছে প্রেম, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। সবই দেশের প্রতি। অনেক শুভেচ্ছা মা ও মেয়েকে।